সারা বিশ্ব যখন মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যস্ত, বাংলাদেশে তখন কখনো কখনো এর ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ (WHO) সারা বিশ্বের খাদ্য ও পুষ্টি নিয়ে কাজ করা সবার পরামর্শ থাকে খাবারে যেন পর্যাপ্ত কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, মিনারেলস ও পানি থাকে, যাকে বলা হয় সুষম খাবার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সুষম খাবার ব্যতীত কোনোভাবেই শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি সম্ভব নয়। বাংলাদেশ সরকারও প্রাইমারি লেভেল থেকে সব শ্রেণিতে সুষম খাবারের গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করেছে, যাতে সবাই এর উপকারিতা সম্পর্কে জানতে পারে।
সম্প্রতি ওজন বেড়ে যাওয়া কিছু মানুষ এমন এক পদ্ধতির আশ্রয় নিচ্ছে—তাতে করে তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হুমকির মুখে পড়েছে। ডায়েট কন্ট্রোল করাটা এখন বেশ পরিচিত সবার কাছে, যেটা খুব ভালো লক্ষণ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে অনেকেই ডায়েট কন্ট্রোল করা মানে ভাবছেন—খাবারে কার্বোহাইড্রেট না খাওয়া মানেই ডায়েট কন্ট্রোল করা। শরীরের শক্তির প্রধান উত্স কার্বোহাইড্রেট, যেটাকে বাদ দিয়ে শরীরকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে ধীরে ধীরে।
প্রায় ১০০ বছর আগে বাচ্চাদের এপিলেপসি বা খিঁচুনি রোগের চিকিৎসায় আবিষ্কৃত কিটো ডায়েট হঠাৎ করেই ওজন কমানোর ডায়েট হিসেবে জনপ্রিয় করা হচ্ছে। ভয়ানক কথা হচ্ছে ডায়াবেটিস রোগীদের ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া, এমনকি ইনসুলিনও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। আর সেটা করা হচ্ছে ঢালাওভাবে ইউটিউব বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ইউটিউবে কখনো কোনো চিকিত্সা কোনো রোগীর সামগ্রিক ক্লিনিক্যাল তথ্য না জেনে দেওয়াটা চিকিত্সাবিজ্ঞান সাপোর্ট করে না। একেকজন মানুষের চিকিৎসা একেক রকম, সেটা শুধু তার সব তথ্য জেনেই দেওয়া সম্ভব। আপনি না খেয়ে থাকলে বা একেবারে কম খেলে ওজন কমে যাবে—এটা স্বাভাবিক; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে যে আপনার শরীরে পুষ্টির ঘাটতি হবে সেটার অভাব পূরণ করবে কে?
কিটো ডায়েট করা মানুষদের চুল পড়ে যায়, স্কিনের বিভিন্ন রোগ হয়, প্রচণ্ড মাইগ্রেনের ব্যথা হয়। যারা ডায়াবেটিসের ওষুধ বন্ধ করে দেয় বা ইনসুলিন নেওয়া বন্ধ করে দেয়, তাদের অনেককে আইসিইউ পর্যন্ত যেতে হয়। ব্রেনের প্রধান খাবার গ্লুকোজ ব্রেনে না পৌঁছানোয় অনেকের কিছু মনে না থাকার ব্যাপারটাও ঘটে। বেশি কিটোন বডিস তৈরি হওয়ায় নিউরোলজিক্যাল বিভিন্ন রোগ হওয়ার ঝুঁকি তো আছেই। দেশের বা দেশের বাইরের ডায়াবেটিস, হার্ট, কিডনি অ্যাসোসিয়েশন বিভিন্ন সময় এটা নিয়ে কথা বলেছে। এটার ক্ষতির কথা জানিয়েছে। যেহেতু দ্রুত ওজন কমে—এটা অনেকের কাছেই বেশ জনপ্রিয়, যেহেতু কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করে না, তাই ইনসুলিনের প্রয়োজন পড়ে না। আবার যখন স্বাভাবিক খাবারে ফেরত আসবে, তখনো যদি ইনসুলিন বা মেডিসিন না গ্রহণ করে, বিপত্তিটা তখনই ঘটে; কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো বাংলাদেশে এটাকে ইচ্ছা করে জনপ্রিয় করা হচ্ছে। কারণ ভাত, রুটি খাওয়া বাদ দিয়ে যেসব খাবারের অভ্যস্ততা করা হচ্ছে, সেগুলোর সঙ্গে বেশ ব্যাবসায়িক স্বার্থ রয়েছে। ইউএস নিউজ সূত্রমতে, আমেরিকার পুষ্টিবিদ ও ডায়েটেশিয়ানদের মাঝে পরিচালিত জরিপে ২০২০ সালের সর্বনিকৃষ্ট ডায়েট নির্বাচিত হয়—কিটো ডায়েট।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, কিটো ডায়েটের ফলে প্রাথমিকভাবে ওজন কমানো গেলে এবং পরবর্তী সময়ে কিটো ডায়েট ছেড়ে দিলে তার থেকে বেশি ওজন বৃদ্ধি ঘটে। এ ছাড়া কিটো ডায়েটের ফলে নিম্ন রক্তচাপ, কিডনিতে পাথর, কোষ্ঠকাঠিন্য ও হূদেরাগের ঝুঁকি বাড়তে পারে। কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদলের ইঁদুরের ওপর করা এক গবেষণা থেকে জানা যায়, গর্ভাবস্থায় কিটো ডায়েট ভ্রূণের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে, যেমন—মৃত/বিকলাঙ্গ বাচ্চা প্রসব, বাচ্চার বিলম্ব বৃদ্ধি, মানসিক বৈকল্য ইত্যাদি।
শারীরিক সমস্যার ক্ষেত্রে আপনাকে সেই বিষয়ের বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। না জেনে নিজের শরীরের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে সেটার পরিণাম আপনাকে অবশ্যই ভোগ করতে হবে। অপরিকল্পিত কিছু করলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাবে; তখন শুধু করোনা না, যেকোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া আপনাকে আক্রমণ করতে পারে। মনে রাখবেন ওজন কমানো জরুরি; কিন্তু তার চেয়েও বেশি জরুরি সুস্থ থাকা। গর্ভাবস্থায় কিটো ডায়েট ভয়াবহ ফল নিয়ে আসতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং
সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি